রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৩

জেল থেকে লতিফ-কাদের সিদ্দিকীকে হ*ত্যা*র ছক

আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং তার ভাই কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী আরেকটি রাজনৈতিক পরিবার। 

স্থানীয় রাজনীতিতে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে ভয়ংকর এ পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় ২৮ লাখ টাকা খরচ করে সিরিয়াল কিলার হিসেবে পরিচিত মধুপুরের সাগর আলীকে জামিনে জেল থেকে বের করা হয়। 

জেলা কারাগারে বসে জাতীয় পর্যায়ের এ দুই নেতাকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করেন টাঙ্গাইলের খান পরিবারের সদস্য সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি। আওয়ামী লীগ নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় তিনি এখনো কারাগারে।জানা গেছে, পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে সিদ্দিকী পরিবারে ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ উদ্দেশ্যে খান পরিবার সাগরকে জামিনে বের করে আনে বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পরই লতিফ সিদ্দিকী ও কাদের সিদ্দিকীকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।


এ বিষয়ে কথা বলার জন্য টেলিফোনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে যেসব তথ্য আছে, সে বিষয়ে অবহিত হন। 

বিস্তারিত শোনার পর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’বিভিন্ন মাধ্যম থেকে হত্যার পরিকল্পনার তথ্যটি জানলেও সিদ্দিকী পরিবার থেকে নিরাপত্তা চাওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। নিরাপত্তা চাওয়া হলে পুলিশ সে ব্যবস্থা করবে।’


এদিকে মধুপুরে একই পরিবারের চারজন হত্যা মামলার আসামি জামিনে বের হওয়া নিয়ে টাঙ্গাইলের আদালতপাড়ায় কানাঘুষা চলছে। সাগরকে যে গ্রাউন্ডে জামিন দেওয়া হয়েছে, তা সত্য নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সাগরের জামিনের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দরখাস্তকারী আসামির নাম এজাহারে নেই এবং তাকে কোনো প্রকার সন্দেহ করা হয়নি। তার কাছে কোনো আলামত উদ্ধার হয়নি। 

দরখাস্তকারী আসামি ২১/৭/২০ তারিখ থেকে প্রায় দুই বছর ৯ মাসের অধিককাল যাবত হাজতে আছে। এই বিবেচনায় ১৫/০৫/২০২৩ তারিখে আসামি সাগর আলী জামিনে মুক্তি লাভ করে।’


মধুপুর থানার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা বলছেন, মধুপুর চারজনকে হত্যার পর যে মামলাটি হয়েছিল, তা সাগর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে। স্বাভাবিকভাবেই মামলাটি অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সাগর গ্রেপ্তারের পর যে ছুরি দিয়ে চারজনকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ছুরিটিও উদ্ধার করে র্যাবআইনজীবীরা জানান, আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, হত্যায় ব্যবহৃত আলামত থাকার পরও এমন আসামির জামিন হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক।

নানা কারণেই টাঙ্গাইলের আইনজীবীরাও নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, ‘কোনো অদৃশ্য ইশরা ছাড়া এ জামিন সম্ভব ছিল না। এ জামিন প্রক্রিয়া নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।’

কারাগারে বসে দুই নেতাকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলার জন্য টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তির বাবা টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আপনি আমার সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে তারপর এ ধরনের প্রশ্ন করেন!’

খান ও সিদ্দিকী পরিবারের পাঁচ দশকের দ্বন্দ্ব: টাঙ্গাইলের খান পরিবার রাজনীতিতে আসে ৫০-এর দশকে। ১৯৫৪ থেকে ৫৬ সালে শামসুর রহমান খান শাহজাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি হন। তিনি ১৯৬৫ সালে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। অন্যদিকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ১৯৬৪-৬৫ সালে টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন।


শামসুর রহমান খান শাহজাহানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন তার ভাতিজা আমানুর রহমান খান রানা, সহিদুর রহমান খান মুক্তি, সানিয়াত খান বাপ্পা ও জাহিদুর রহমান খান কাকন।


অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি হন লতিফ সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। যুদ্ধ-পরবর্তী তিনিও টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান করে নেন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে কাদের সিদ্দিকী গঠন করেন ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ’। তার দুই ভাই আজাদ ও মুরাদ সিদ্দিকীও কাদের সিদ্দিকীর দলে যুক্ত হন।


টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের একাধিক বর্ষীয়ান রাজনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে খান ও সিদ্দিকী পরিবারের দ্বন্দ্ব শুরু হলেও এক পর্যায়ে এর নানা ডালাপালা ছড়িয়ে যায়। দুই পরিবারের নির্বাচনী আসন এক না হলেও তাদের বসবাস টাঙ্গাইল সদরে। শহরের রাজনীতি, ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে দুই পরিবার।


টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘খান পরিবার টাঙ্গাইলের রাজনীতি থেকে আউট হইছে একজন মুক্তিযোদ্ধা মার্ডার মামলায় হুকুমের আসামি হওয়ার কারণে। সিদ্দিক পরিবারের কাদের সিদ্দিকী আউট হন ৯৮ সালে। লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে মন্তব্য করে বিপাকে পড়েন।’


তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইলে ক্ষমতার দখলদারিত্ব নিয়েই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব। এদের বাইরে কেউ টাঙ্গাইলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত না। দুপক্ষই প্রচুর মার্ডারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। দুই পরিবার রাজনীতিতে ক্ষমতা হারানোয় প্রভাব বাড়ে ছোট মনির ও বড় মনিরদের।




শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.