Breaking News

ঢাকায় কেন এত ভবন বিস্ফোরণ?

দুদিনের ব্যবধানে রাজধানীর দুটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত ২৩ জনের প্রাণহানি ও শতাধিক আহতের ঘটনায় ফের সামনে এসেছে দুটু প্রশ্ন।

প্রশ্ন নম্বর ১- ঢাকায় এত ভবন বিস্ফোরণ কেন?

প্রশ্ন নম্বর ২- এ ধরনের দুর্ঘটনার পেছনে দায়টা আসলে কার?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে টিম টাচ স্টোনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নানা বিষয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন মেগাসিটি ঢাকার সুউচ্চ ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রতিযোগিতা করে গড়ে উঠলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না কেউ।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সে ধরনের কোনো সমন্বয় নেই বললেই চলে।

এদিকে নয়-ছয় করে পাড় পেয়ে যাচ্ছে তিতাস।
এ যেন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে সব।

ঢাকার তলদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে গ্যাসলাইন। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এতকিছুর পরেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে এর কোন নকশা পর্যন্তও নেই।

তারা জানেও না কোথায় কোথায় গ্যাস লাইন রয়েছে! আবার সেগুলোর সংস্কারও করা হচ্ছে না।

বিদ্যুতেরও প্রায় একই অবস্থা।
ফলে রাজধানীতে এমন মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হচ্ছে না। এখনই এসব ঘাটতি দূর ও সমন্বয় জোরদার করতে না পারলে ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে।

অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক কর্মকর্তা এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, সাধারণত তিন কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রথমত, প্রকৃতিপ্রদত্ত ঝড়-বৃষ্টি।

দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনাবশত (যা ভবনের সুয়ারেজ লাইন, মিথেন বা ন্যাচারাল গ্যাস, এলপি গ্যাস, তেলজাতীয় বা দাহ্যজাতীয় পাউডার থেকে সৃষ্ট)।

আর তৃতীয় কারণটি হলো- উদ্যেশ্যপ্রণোদিত। যেমন- ভবন মালিকদের শত্রুতা বা বৈরিতা, ভবন ঋণ বা ইনস্যুরেন্স, তৃতীয় পক্ষের ক্ষোভসহ ব্যক্তিক নানা ইস্যু।

যেহেতু প্রথম ও তৃতীয় কারণে বেশির ভাগ সময়ই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে না, তাই দ্বিতীয় কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। কিন্তু দ্বিতীয় কারণে এখন পর্যন্ত যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা বন্ধে বা কমিয়ে আনতে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। এই পরিস্থিতি না বদলালে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীজুড়ে ৭২ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা এখন টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, রাজউক বছরে গড়ে ১০-১৫ হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু গড়ে প্রতি বছর ৯০ হাজারের বেশি ভবন তৈরি হচ্ছে।

তাহলে বাকিটা কীভাবে হচ্ছে? আর এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই কেচো খুড়তে বেরিয়ে আসবে সাপ। সেটি সবারি জানা।

একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে রাজধানীতে গ্যাস থেকে ৮টি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ বনানীর সিলভার স্টোন ভবনে বিস্ফোরণে কেউ নিহত না হলেও ৬ জন আহত হন।

ওই বছরই ২৪ জুন উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪ জন নিহত ও ৬ জন আহত হন।

২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী ধলপুরে বিস্ফোরণে ৬ জন নিহতসহ আহত হন ১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন নিহত হওয়াসহ আহত হন ৩৭ জন। পরের বছর ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০ জন আহত হন।

একই বছর ১২ নভেম্বর একই এলাকায় বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৮ জন আহত হন। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় বিস্ফোরণে মারা যান ৯ জন, আহত হন আরো ৬৬ ব্যক্তি।

কয়েকটি দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।যেগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন সামনে এসেছে, সেখানে বিস্ফোরণের পেছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে।

প্রতিবারই ঘটনার তদন্তে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বেশির ভাগ সময়ই দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ভবন মালিকের ওপর। অনেক বিষয় তদারকি করা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলেও বারবার তাদের দায় এড়াতে দেখা যায়।

২০১৩ সালে রানা প্লাজার ঘটনাটি ঘটেছিলো ঢাকার কাছে সাভারে। তবে ওই ঘটনায় হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপে গার্মেন্ট কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত করার কাজ হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো চাপও আসেনি আবার কর্তৃপক্ষের দিক থেকেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

২০১০ সালের জুনে ঢাকার নিমতলীতে বাসা বাড়িতে থাকা রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলো ১২৪ জন।

অথচ পুরনো ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম কত আছে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাবও কারও কাছে নেই।

ধরেন রাজধানীর পুরান ঢাকার কথাই সেখানে ২৫ হাজার ভবন আছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশের কোনো অনুমোদনই নেই। আবার যেসব ভবন আছে, সেগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই আছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার তালিকায়। তার পরও সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। পুরান ঢাকাকে নিরাপদ বাসযোগ্য করতে হলে প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ভেঙে ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

এতকিছুর পরেই সব নাটকের অবসান ঘটে একইভাবে। প্রথমে দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সেই তদন্ত জমা দেয়ার আগেই আরেকটি দুর্ঘটনায় চাপা পড়ে যায় আগের কাহিনী। 

Type and hit Enter to search

Close