বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০২৩

মুখে দাড়ি থাকায় প্রায় ২৭ বছর ধরে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন সুফিয়া

পুরোনো একটি বাড়িতে একই বসবাস করেন। মুখে লম্বা দাড়ি। কোনোটা কাঁচা আবার কোনোটা পাকা। পরিচর্যায়ও করেন নিয়মিত। মুখে দাড়ির কারণে প্রয়োজন ছাড়া বের হন না বাড়ি থেকে। বের হলেও মুখ ঢেকে রাখেন। 

বলছিলাম ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সোনাদাহের গোয়ালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুফিয়া বেগমের (৬১) কথা। মুখে দাড়ি থাকায় প্রায় ২৭ বছর নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন তিনি। সুফিয়া বেগমের পরিবার পরিজন বলতে বোন ও বোনের সন্তানরা ছাড়া আর কেউ নেই। বিয়ের পর সন্তান হলেও জন্মের পরই মারা যান। কিছুদিন পর স্বামীও মারা যান। খুবই কষ্টের জীবন পার করতে হয়েছে তাকে। এখন সব মেনে নিয়েছেন তিনি। জীবনে সব কিছু হারিয়ে শেষ বয়সে একটি মুরগির ফার্মে কাজ নিয়েছেন। সেখান থেকে যা পান তা দিয়েই চলেন। অবসর সময়ে কাঁথা সেলাই, এলাকার নারীদের কোরআন শিক্ষা দেন। 

সুফিয়া বেগম ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সোনাদাহের গোয়ালপাড়া গ্রামের মৃত হবিবার জমাদ্দারের মেয়ে। তিনি বর্তমানে ঝিনাইদহ পৌরসভার পবহাটি গ্রামে থাকেন।

সরেজমিনে পবহাটি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি মুরগির খামারের পাশে নিরিবিলি পুরোনো একটি বাড়ি। বাড়ির ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে উঠানে সবজির মাচা। সেই সবজি পরিচর্যা কাজ করছেন সুফিয়া বেগম। 

প্রথমে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার মুখে লম্বা দাড়ি আছে। কাছে গিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখা যায় তার মুখে লম্বা দাড়ি। মুখে বয়সের ছাপ। বাড়ির সঙ্গে মুরগির খামার দেখাশোনা করেন তিনি। কখনো সেই মুরগিকে খাবার দিচ্ছেন, কখনো নিজ হাতে সুঁই-সুতার মাধ্যমে কাঁথায় ফুল তুলছেন। একাই থাকেন তিনি। গ্রামের অন্য পাশে থাকা বোনের মেয়ে তার দেখাশোনা করেন। 

সুফিয়া বেগমের প্রতিবেশী সবুজ মিয়া বলেন, সুফিয়া বেগমের বাড়ি গোয়ালপাড়া এলাকায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পবহাটি এলাকায় বোনের মেয়ের হেফাজতে একটি বাড়িতে থাকেন। একটি মুরগির ফার্ম দেখাশোনা করেন। তার মুখে দাড়ি আছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। নারীর মুখে দাড়ি এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। নারীর মুখে এতো বড় বড় কাঁচা-পাকা দাড়ি এর আগে কখনো দেখিনি। 

তার নিজের একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকারসুফিয়া বেগম বলেন, আমরা চার বোন এক ভাই। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। বড় হয়েছি মামার বাড়িতে। ১২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর একটি সন্তান হয়। সন্তানটি জন্মের পরই মারা যায়। 

কয়েক বছর পর স্বামীও মারা যায়। ১০ বছর পর মামারা আবারো দ্বিতীয় বিয়ে দেয়। সেই স্বামীও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তারপর আর বিয়ে করা হয়নি। সব হারিয়ে বোনদের বাড়িতে, বোনের মেয়েদের বাড়িতে থাকি। ছোট থেকেই জীবনে অনেক কষ্ট, সব সময় আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করি।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে পেটে টিউমার হলে ঝিনাইদহের হাসান ক্লিনিকে অপারেশন করা হয়। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার পর রাতে ঘুমালে হঠাৎ স্বপ্ন দেখি একটা হুজুর স্বপ্নে আমাকে বলছে, তোর মুখে দাড়ি উঠবে, তুই কাউকে বলবি না। বোনের বাড়ির পাশে একটি আম গাছ দেখিয়ে বলে- তুই ওই আম গাছের গোড়ায় চারিদিক কাপড় টাঙিয়ে ওখানেই থাকবি। সমস্যায় পড়ে কোন মানুষ আসলে কলসিতে পানি পড়ে রাখবি, সেই পড়া পানি রোগীদের দিবি, তাদের রোগ ভালো হয়ে যাবে। তোর হাতের জয় হবে। 

তখন আমি বলি- আমার কোনো সন্তান নেই, স্বামী নেই, কোনো টাকা-পয়সাও নেই, পরের বাড়ি থাকি। আমি যদি ওখানে থাকি তাহলে কে আমাকে টাকা-পয়সা দেবে, খেতে দেবে। 

তখন হুজুর বলে- তুই ওখানে থাকবি। আল্লাহই তোর খাবারের ব্যবস্থা করে দেবে। এই বলে আমাকে দোয়া শিখিয়ে দিয়ে যায় এবং বালিশের পাশে এক বান্ডিল টাকা রেখে যায়। হুজুর সতর্ক করে বলে এই কথা কাউকে না বলতে। পর দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মুখে দাড়ি। সত্যি সত্যি আমার মুখে দাড়ি উঠেছে। তখন আমি বাহিরে এসে বোনের মেয়েদের বলি এই তোরা দেখ আমার মুখে দাড়ি উঠেছে। তখন ওরা এসে দেখে সত্যিই আমার মুখে দাড়ি। তখন ওদের কাছে হুজুরের দেওয়া টাকার কথাও বলি। ওদের সাথে টাকার কথা বলে ঘরের ভেতর টাকা আনতে গিয়ে দেখি, বালিশের পাশে যে টাকা রেখে গেছি সেই টাকা আর নেই। 

তখন আমার হুজুরের কথা মনো হলো হুজুর এই কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল।তিনি বলেন, মুখে দাড়ি নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারতাম না। যার কারণে দাড়ি উঠলে কেটে ফেলতাম। কোথাও যেতাম না। বাড়িতে থাকলেও ঘর থেকে কম বের হতাম। কোথাও গেলে সব সময় মুখ লুকিয়ে থাকতাম। এরপর ভাই মারা যাওয়ার কিছু দিন পর আমার স্ট্রোক হয়। এক মাস ১০ দিন কথা বলতে পারিনি। হাত পা মেলাতে পারিনি। তখন বোনের মেয়ে হাত ধরে শপথ করালো আমি যেন আর কোনো দিন দাড়ি না কাটি। তারপর থেকেই সুস্থ। এখন বয়স হয়ে গেছে। দেখার কেউ নেই। এখন আর মুখ বেঁধে থাকতে পারি না। তাই এখন মুখে দাড়ি নিয়েই বের হতে হয়। বোনের মেয়েরা দেখাশোনা করে।

সুফিয়া বেগম বলেন, এক সময় প্রচুর কান্নাকাটি করেছি, এখন সব মেনে নিয়েছি। বাড়ি থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হই না। জীবনে সব কিছু হারিয়ে শেষ বয়সে একটি মুরগির ফার্মে কাজ করি। এখান থেকে যা পাই তা দিয়েই চলে। অবসর সময়ে কাঁথা সেলাই, এলাকার নারীদের কোরআন শিক্ষা দেই। বোনের মেয়ে একটা প্রতিবন্ধী ভাতা করে দিয়েছে। তাছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাই না। শেষ বয়সে এসে যদি কেউ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতো, তাহলে হয়তো নিজের একটা নিরাপদ ঘর করে সেখানেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের গাইনি কনসালটেন্ট ডা. আলাউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে জানান, হরমনজনিত কারণে নারীদের মুখে দাড়ি হতে পারে। তাছাড়া এটা কঠিন কোন রোগ নয়।

ঝিনাইদহ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বুলবুলি ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুফিয়া বেগম আমার খালা, মুখে দাড়ির কারণে লজ্জায় কোথাও যেতে চান না। বর্তমানে তিনি আমার হেফাজতে আছেন। আমার গ্রামের একটি মুরগির ফার্মের পাশে তাকে রাখা হয়েছে। তিনি বৃদ্ধ মানুষ, ওই মুরগির ফার্মটা দেখাশোনা করে সেখান থেকে কিছু টাকা পান। তা দিয়েই চলেন। 

আমি তাকে নিয়মিত দেখাশোনা করি, খাবার দিই।তিনি বলেন, নারীর মুখে দাড়ি এটা খুবই বিড়ল। তার কোনো সন্তান নেই। স্বামীও মারা গেছেন। মুখে দাড়ির কারণে কোথাও যেতে চান না, যার কারণে ওই ভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সরকার থেকে তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু তিনি বৃদ্ধ মানুষ কবে কখন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে এজন্য অন্য কোথাও যেতে দিইনি। নিজের কাছেই রাখতে চাই। যদি কেউ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে আমার নিজের জায়গা আছে সেখানে ঘর করে দিলে সেখানে থাকতে পারবেন। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও আমি তাকে দেখতে পারব।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.